শিক্ষা সুযোগ নয়,
অধিকার
ভ্যাট প্রত্যাহার করে
শিক্ষাখাতে ব্যয় বাড়াতে হবে
- আশিস বিশ্বাস
শিক্ষা সুযোগ নয়,
অধিকার- এ স্লোগানটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো আগাগোড়াই দিয়ে এসেছে। এখনো দেয়, তবে কম। মনে আছে, এক সময় তারা ইউনেস্কো ঘোষিত সনদ
অনুযায়ী জাতীয় আয়ের ৭ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দের দাবি জানিয়ে এসেছেন।
বাংলাদেশের
সংবিধান অনুযায়ী, শিক্ষা অধিকার, সুযোগ নয়। প্রত্যেক নাগরিকের বাধ্যতামূলক
শিক্ষাদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং সেটা হওয়ার কথা অবৈতনিক। সবার জন্য শিক্ষা মৌলিক
অধিকার।
বাংলাদেশ স্বাধীন
হওয়ার পর কুদরাত-ই খুদা শিক্ষা কমিশন সুপারিশ করেছিল, দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে না। শিক্ষা
হবে একমুখী। অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষামাধ্যম, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেসরকারি কোনো
শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে না। সবাই মৌলিক
অধিকার হিসেবে শিক্ষা অর্জন করতে পারবে। ব্যক্তিমালিকানায় বা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
থাকবে না।
কিন্তু ৭৫ সালের
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংবিধানের ধারা উপেক্ষিত হয়েছে। এখনো তা চলছে।
সংবিধান বলছে, দেশের সবার শিক্ষাদান করবে রাষ্ট্র এবং সেটি হবে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার
মাধ্যমে। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন।
অনেক রাজনৈতিক দল
ক্ষমতায় এলো আর গেল। কিন্তু লুটেরাদের অবস্থান সাধারণ নাগরিকদের স্বার্থবিরাধী। সে
কারণে সংবিধান লঙ্ঘন করেই তারা ইংরেজি শিক্ষামাধ্যম, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠা করে। এ সব প্রতিষ্ঠানের মালিক হয় মন্ত্রী, এমপি কিংবা বড় বড় ব্যবসায়ী।
শিক্ষা মৌলিক
অধিকার হলেও ব্যক্তি স্বার্থে মুনাফা অর্জনের উপায় হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে
পণ্য বানিয়েছেন। শিক্ষা পণ্য আর শিক্ষার্থীরা ভোক্তা। অথচ শিক্ষা একটি সেবাখাত,
যেমনটা স্বাস্থ্যখাত। সেবাখাত মানে রাষ্ট্র এখাতে ভর্তুকি দেবে। রাষ্ট্র
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে। এ ছাড়া জাতীয় আয়ের নির্দিষ্ট একটা অংশ শিক্ষাখাতে
বরাদ্দ করবে । ইউনেস্কো এটা নির্ধারণ করেছে জাতীয় আয়ের ৭ শতাংশ।
এদিকে, ক্ষমতার
অপব্যবহার করে দেশে শিক্ষায় বৈষম্য তৈরি করা হয়েছিল। বিভাজন টানা হয়েছিল, সাধারণ
শিক্ষা আর ধনিক শ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে। পরবর্তীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকটের কারণে মধ্যবিত্ত ঘরের
ছেলেমেয়েরাও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হন।
দেশে এখন সম্ভবত ৮৩টির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, হাতেগোনা দুই/একটি
ছাড়া বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রতিষ্ঠার শর্ত পূরণ করেনি। ফলে যে সব
শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ
থেকে মানসম্মত শিক্ষাটা পাচ্ছেন না। এ ছাড়া ভৌত সমস্যা তো আছেই।
আরো দু:খের বিষয়,
বেসরকারি বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় যারা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
প্রতিষ্ঠার ন্যূনতম শর্তগুলোও পূরণ করেনি। শিক্ষার্থীদের যে সব সুবিধা দেওয়ার কথা,
তা বেসরকারি বিদ্যালয়ের মালিক/কর্তৃপক্ষ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে
এবং এখনো করে চলেছে। অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাতে তাদের সব শর্ত পূরণ
করে, তার জন্য কঠোর নজরদারি করেনি সরকার। এর কারণ, যারা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক,
হয় তারা নিজেরাই ক্ষমতায় আছেন কিংবা ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান করছেন। সে কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতারণা করে
কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মালিক পক্ষ। রাষ্ট্র এ সব
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করলে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি এত টিউশন ফিসহ
নানা অজুহাতে প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা বছর বছর হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকতো না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
মালিক/কর্তৃপক্ষ শিক্ষাকে একবারেই পণ্য বানিয়ে ফেলেছেন দেশের সংবিধানকে লঙ্খন করে।
শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে ফেলেছেন বলেই অর্থমন্ত্রী বলার সাহস পাচ্ছেন, ভ্যাট দিতেই
হবে। ভ্যাট তো দিতে হয় তো পণ্য কেনার জন্য। অর্থাৎ ভোগের নিমিত্তে। যেমন- হোটেল
রেস্টুরেন্টে খেলে ভোক্তাকে ভ্যাট দিতে হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়
মালিক/কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি শিক্ষাকে পণ্য হিসেবেই বিবেচনা করে ভ্যাট চাইছেন তিনি।
অদ্ভুত দেশ। রাষ্ট্রও মনে করছে, শিক্ষা পণ্য; নইলে ভ্যাট চাইবে কেন!
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীরা যে দাবি তুলেছেন, তা রাষ্ট্রের মেনে নেওয়া উচিত। শুধুই তাইই নয়, আমি
আরো এক ধাপ এগিয়ে দাবি করবো, সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অধিগ্রহণ করে পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করা হোক। তাহলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব
শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে যাবেন। তাদের মাসিক বেতন, হল,
সিটভাড়া, ডাইনিং, ক্যান্টিন, খেলার মাঠ, বড় ক্যাম্পাসের সুযোগ ভোগ করতে পারবেন।
তাদের টিউশন ফি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বছরে কয়েক হাজারে এসে ঠেকবে এবং
শিক্ষারমানও উন্নত হবে। কারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবস্থাপনা আর লুটেরা
মনোভাব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জীবন অনিশ্চিতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তাই আমার দাবি, সব বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়কে অধিগ্রহণ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হোক। এতে করে
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাও বাঁচবেন আর দেশবাসী মানসম্মত শিক্ষার সুফল ভোগ করতে
পারবেন।
তাই আর দেরি না করে
সংবিধান অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর আরোপিত ভ্যাট
প্রত্যাহার করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হোক। আর তাতে আমরা শিক্ষিত জাতি
উপহার হিসেবে পাবো। বাস্তবায়ন হবে কুদরাত-ই খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ, যা ৭২
পরবর্তী সরকার একান্তভাবেই চেয়েছিল। বিশেষত, বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল
কুদরাত-ই খুদার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা।
মনে রাখতে হবে, শিক্ষা
মৌলিক অধিকার এবং সেবাখাত। এতে কোনো ধরনের ভ্যাট আরোপ করা যায় না। ভুতুড়ে ভ্যাট (ভ্যালু
অ্যাডেট ট্যাক্স, মূল্য সংযোজন কর) প্রত্যাহার করুন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে
রূপান্তর করুন। তাহলেই দেশ এক বিভাজনের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে রেহাই পাবে। সাড়ে ৭
শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে বরং জাতীয় আয়ের (ইউনেস্কো ঘোষিত) ৭ শতাংশ শিক্ষাখাতে
ব্যয় করুন। এটিই এখন রাষ্ট্রের জরুরি দায়িত্ব।
মনে রাখতে হবে- সংবিধান
অনুযায়ী, শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার।
No comments:
Post a Comment