Popular Posts

Sunday, February 21, 2016

দেশটা কি মস্করার নাকি চাটুকারিত্বের!


 দেশটা কি মস্করার নাকি চাটুকারিত্বের!

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক দ্য ডেইলি স্টার

আশিস বিশ্বাস, অনলাইন সংবাদকর্মী, mail: ashishbiswas@rocketmail.com

দেশটা আসলে মস্করার হয়ে গেছে। সে কারণে অকারণেই এত এত মস্করা করা হচ্ছে। অথবা বলা চলে, দেশে এত চাটুকার যে, শুধু গিজগিজ করছে। এক চাটুকারের সঙ্গে আরেক চাটুকারের ধাক্কা লাগছে। তা নাহলে ১/১১-এর সময়কার একটি সংবাদের জন্য দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে এত এত মামলা হচ্ছে কেন!

ওই আমলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা সংবাদ যাচাই না করে প্রকাশ করায় শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

কিন্তু যারা সংবাদটি প্রকাশের জন্য দিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারিত হচ্ছে না কেন‍! মামলা তো আরো পরের ব্যাপার! সবার আগে তো ওই গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধেই মামলা হওয়া উচিত, মিথ্যা ও বানোয়াট প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সংবাদমাধ্যমে দিয়েছিল বলে! কিন্তু কই...! তা তো হচ্ছে না! কিন্তু কেন! 


তথ্য যাচাই না করে তা ডেইলি স্টারে প্রকাশ করা করা হয়েছিল এবং এটা ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন, পত্রিকাটির সংবাদ মাহফুজ আনাম

তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, ওই সংবাদে লেখা হয় যে, 'এ তথ্য নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি'। তা তিনি এটিএন নিউজ চ্যানেলে আলোচনাকালে সরাসরিই বলেছেন। অর্থাৎ সংবাদ প্রকাশের নীতি মেনেই সংবাদটি প্রকাশ করেছেন। তবে সেটি আরো যাচাইবাছাই করা উচিত ছিল। সে কারণে বিনয়বশত ডেইলি স্টারের সম্পাদক বলেছেন যে, সেটি ছিল ভুল এবং তার জন্য তিনি দুঃখিত। এরপরে তো আর কোনো কথা চলে না।

যখন কোনো নিরপেক্ষ সূত্র থেকে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্তবপর হয় না, তখন এ কথা উল্লেখ করাই যে কোনো সংবাদমাধ্যমের নৈতিকতা; যাতে পাঠক বুঝতে পারেন যে, সংবাদমাধ্যম তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে সক্ষম হয়নি। তা যে কোনো কারণেই হোক না কেন। সে ক্ষেত্রে ডেইলি স্টার সেই নৈতিকতা মেনেই সংবাদটি প্রকাশ করেছিল। তারপরও মাহফুজ আনামকে যেভাবে মৌমাছির মতো আক্রমণ করে মামলা দেওয়া হচ্ছে, সেটি এক ধরনের অতিউৎসাহী কর্মকাণ্ড। সোজা কথা বলা যায়, এগুলো আসলে এক ধরনের নির্দয় মস্করা কিংবা দলীয় নেতৃত্বকে খুশি করতে চাটুকারিতা। এ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না একে। 

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম সেদিন কী বলেছিলেন টেলিভিশন আলোচনায়, সে বক্তব্যটি শুনুন নিচের লিংকে দেওয়া ইউটিউব থেকে-

এটিএন নিউজকে মাহফুজ আনাম

এটা নিয়ে সাধারণ মানুষ কিংবা সংবাদকর্মী কিংবা মানবাধিকার সংস্থা অথবা যার বিরুদ্ধে সংবাদটি প্রকাশ করা হয়েছিল, তিনি কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। অর্থাৎ যার মানহানি হয়েছে বলে মামলা করতে পারতেন, তিনি একেবারেই চুপ।

যাদের কথা বলা হলো, তারা সবাই-ই জানেন, কী পরিস্থিতিতে তা করতে হয়েছে। যখন আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি ক্ষমতায় থাকে, তখনও কোনো সংবাদমাধ্যমই স্বাধীনতা ভোগ করে না। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তারা সে সময় তাদের বিরুদ্ধ সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেয়।

বর্তমান আওয়ামী লীগের সময় ‘ইসলামিক টিভি’, ‘দিগন্ত টিভি’ ‘আমার দেশ’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ‘একুশে টিভি’ তারেক রহমানের বক্তব্য সরাসরি প্রচারের পর অন্য অভিযোগে তার খোলনলচে বদলে দেওয়া হয়েছে। একুশে টিভি নামটা আছে। আর কিছুই নেই।

আবার বিএনপি আমলে তখনকার টেরিস্ট্রিয়াল একুশে টিভির লাইসেন্স অবৈধ বলে তার সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তখন দেশের পাঁচটি শহর থেকে একযোগে প্রকাশ হতো যে জনপ্রিয় ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’, তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করে এর জীবন বের করে দেওয়া হয়েছে।

এবার আসি, সামরিক শাসনামলের কথায়। এদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশেই যখন কোনো সামরিক শাসন জারি থাকে, তখন যেমন কথা বলার অধিকার থাকে না, তেমনি সংবাদমাধ্যমও তাদের নিজেদের সংবাদ প্রচার করতে পারে না। তাদের বাধ্য করা হয়, সামরিক শাসকদের তালিকা, টেলিফোন কিংবা তাদের নির্দেশমতো সংবাদ প্রচার করার। কোন সংবাদ প্রচার করা যাবে কিংবা যাবে না কিংবা কোন সংবাদ প্রকাশ করার আগে সামরিক শাসক গোষ্ঠীর অনুমতি নিতে হবে, তা জানিয়ে দেওয়া হয়। 

তাদের সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী, সংবাদমাধ্যমকে চালাতে হয়। না হলে, সংবাদমাধ্যম বন্ধ করাসহ সম্পাদক, সাংবাদিকদের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন, নিপীড়ন। নির্যাতনে কখনো কখনো তারা মারাও যান।

এর ব্যতিক্রম হয়নি, ২০০৭ সালের ১/১১-এর পরেও। 

এ সময়ও সামরিক শাসনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এ সময় সব সংবাদমাধ্যমেরই মুখ বন্ধ হয়ে যায়। সে কারণে যে গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদনটি ডেইলি স্টারকে দিয়েছিল, তা না ছাপলে কী অবস্থা যে হতো তা একমাত্র ডেইলি স্টারের সম্পাদক এবং ওই হাউজের সাংবাদিকেরাই জানেন। 

মাহফুজ আনাম হয়ত ভদ্রতাবশত বলেছেন, তথ্যটি যাচাই না করে ছাপানো ভুল হয়েছে। আমি বলবো, ভুল হয়নি। ছাপতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। না হলে অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যেতো। 

সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, ১/১১-এর পর ২৪ ঘণ্টা সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল ‘সিএসবি’ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ, সবারই জানা। 

আরো নিশ্চয় জানা আছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাঘা বাঘা নেতারা তাদের দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে ‘মাইনাস’ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। কারণ কী! সেটাও সবার জানা। এখনকার মন্ত্রীরাও ছিলেন সে দলে। পরে তারা বলেছেন, সামরিক শাসকদের চাপে পড়ে সে কাজটি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

কই তাদের বিরুদ্ধে তো মামলা হচ্ছে না। কেউ তো মামলা ঠুকে দিচ্ছেন না, ওই সব নেতা ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে।

আর যদি মামলা ঠুকতে হয়, তাহলে মিথ্যা তথ্য সরবরাহের অভিযাগ এনে ওই গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধেই তো আগে করা দরকার। কিন্তু কেউ করছেন না কেন! আমরা সবাই, জানি, সেই রকম বুকের পাটা কোনো নেতানেত্রী, মন্ত্রী-এমপি কিংবা ক্ষমতাসীন দলীয় নেতাকর্মীদেরও নেই। 

সেই সংস্থা তো দিব্যি আছে। সেই সংস্থা যদি ওই সময় এই রকম বানোয়াট তথ্য দিয়ে থাকে, তাহলে দেশ তো ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে আছে। বলা চলে, দেশটা তাহলে একটা বোমার ওপর বসে আছে। কিন্তু কই, কেউ তো সে বিষয়ে কথা বলছেন না। মূল হোতার বিরুদ্ধে মামলা না করে যিনি অকপটে স্বীকার করলেন, তার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দায়ের করা একটা জাতির জন্য লজ্জাস্কর। 

আর ক্ষমতাসীন ওই দলটির জন্য অবমাননাকরও বটে!

অদ্ভুত দেশ এটা। যার বিরুদ্ধে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল, চাইলে তিনি মানহানির মামলা করতে পারতেন। কারণ, এতে তার সম্মান নিয়ে টানাটানি করা হয়েছে। তিনি তা করেননি; অথচ যাদের মানহানি হয়নি, তারা মানহানির মামলা দিচ্ছেন, কী অদ্ভুত বিষয়টা!

এটা তো মস্করা করা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। অথবা বলতে হয়, দেশটা কি তবে চাটুকারে ভরে গেল যে, যার মানহানি হয়নি, সে দিচ্ছে মানহানির মামলা!

মজার বিষয় হচ্ছে, এতে করে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের সম্মান বিনষ্ট হচ্ছে না; হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের। দলের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। দেশবাসী বুঝতে পারছেন, কী থেকে কী হচ্ছে। 

বরং মাহফুজ আনাম যেভাবে বিনয়ের সঙ্গে স্পষ্টভাষায় ভুল স্বীকার করে দেশবাসীর কাছে আরো সম্মানিত হয়েছেন। কারণ, সবাই জানেন, সামরিক শাসনের সময় সংবাদমাধ্যমের অবস্থা কেমন থাকে। (যদিও একটি পক্ষ থেকে চাপের কথা তিনি বলেননি), 

কিন্তু যারা মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে কোনো বাপের বেটা আছেন কি যিনি সাহসের সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করবেন! যিনি বা যারা মিথ্যা তথ্য সংবাদমাধ্যমে সরবরাহ করেছিলেন, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন! আছেন কি কেউ? আছেন, কোনো বাপের বেটা!? 



সজীব ওয়াজেদ জয় শুক্রবার বলেছেন, মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত নয়।বেশ ভালো। তার কাছে আমার জানতে চাওয়া, তিনি কি সাহস রাখেন ওই গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে কিছু বলার বা মামলা করার। যদি তিনি সেটা পারেন, তবে তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাবো। বলবো- ‘বীর একজন’। কারণ, একটি গোয়েন্দা সংস্থা মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সংবাদমাধ্যমকে দিয়েছিল প্রকাশের জন্য। তাহলে বিচারের আওতায় আনেন…! যদি বিচারের আওতায় আনতে পারেন, তাহলেই বুঝবো, ক্ষমতায় থেকে আপনারা ক্ষমতায় আছেন!


................................................................................................................................................................
http://www.bbc.com/bengali/news/2016/02/160214_bangladesh_editor_defamation_hasina
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/774433/মাহফুজ-আনামের-বিরুদ্ধে-মামলা-গণমাধ্যমের-ওপর-আঘাত

No comments:

Post a Comment