Popular Posts

Saturday, March 5, 2016

অভিজিৎ হত্যা: যে নারীর সন্ধান পায়নি এফবিআই!

অভিজিৎ হত্যা: যে নারীর সন্ধান পায়নি এফবিআই!

আশিস বিশ্বাস, অনলাইন সংবাদকর্মী
Mail: ashishbiswas@rocketmail.com, Twitter/Ashishkbiswas, Facebook/ashish.biswas.33

ছবি- সংগৃহীত

ঢাকা: ব্লগার, বিজ্ঞান-লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর একবছর পার হয়ে গেছে। তারপরও হত্যাকারীদের সম্পর্কে কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি, আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটার দিকে অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহম্মেদ বন্যা বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা থেকে বের হয়ে আসেন।

এরপর দুজনে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের দিকে আসছিলেন। পথিমধ্যে, টিএসসি এলাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট পার হওয়া মাত্র বোরখা পরা আততায়ীর চাপাতির মুখে পড়েন তারা।

ছবি- সংগৃহীত
বোরখা পরা আততায়ী চাপাতি দিয়ে অভিজিৎ রায়ের মুখ ও মাথা বরাবর উপর্যুপরি কোপাতে থাকলে তিনি ফুটপাতেই লুটিয়ে পড়েন। রক্তে ভেসে যেতে থাকে এলাকা। এ সময় স্ত্রী বন্যা চাপাতির কোপ থেকে অভিজিৎ রায়কে বাঁচাতে গেলে আততায়ী তার হাতেও কোপ মারেন। এতে করে তার হাতের একটি আঙুল কেটে রাস্তায় পড়ে যায়।

পুরো ঘটনাটি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন তুলি নামে এক নারী (পুরো নামটি নিরাপত্তাজনিত কারণে উল্লেখ করা হলো না)।

উপর্যুপরি কোপের আঘাত দেখে তিনি প্রতিবাদ করতে উদ্যত হন। এক পর্যায়ে চাপাতিসহ বোরখা পরা আততায়ীর হাত চেপে জাপটে ধরেন।

কিন্তু আততায়ী তাকেও কুপিয়ে হত্যার হুমকি দেয় ও  তলপেটে লাথি মেরে তাকে রাস্তায় ফেলে দেন। এরপর আততায়ী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট দিয়ে পালিয়ে যান।

এ ঘটনার পর পরই অভিজিৎ রায়কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেদিন রাতেই তিনি মারা যান।

অভিজিৎ হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী নারী- তুলি। ছবি- হিমু

এদিকে, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওই নারী তুলি বিবেকের তাড়নায় এবং নিজের অস্থিরতা চেপে না রাখতে পেরে পরদিন সকালে (২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫) অভিজিৎ রায়কে যেখানে হামলার শিকার হন, সেখানে ছুটে আসেন। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উদভ্রান্তের মতো তিনি শুধু বলতে থাকেন, ‘এত রক্ত আর কখনো আমি দেখিনি। এত রক্ত আর কখনো আমি দেখিনি!’

ছবি দেখে বোঝা যায়, তুলি (৪০) উচ্চ শিক্ষিত নারী। বিলাপ করার পাশাপাশি বার বার মূর্চ্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সংবাদকর্মী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

ওই নারীকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং সংবাদকর্মীদের কাছেও অভিজিৎ রায় হত্যা ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।

 ২.
ছবি- সংগৃহীত
অভিজিৎ রায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন। তার বাবা অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানে অধ্যাপনা করেছেন।

যখন বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিজিৎ রায় হত্যার কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলেন না, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘটনা তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ তা সাদরে গ্রহণও করে।

এরপর অভিজিৎ রায় হত্যা রহস্য উদঘাটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশে আসেন। অভিজিৎ রায়কে যেখানে হত্যা করা হয়, সেই জায়গাটিও পরিদর্শন করেন তারা। ওই সময় কিছু নমুনাও সংগ্রহ করেন এফবিআই সদস্যরা।

বাংলাদেশে অবস্থানকালে এফবিআই সদস্যরা জানতে পারেন, অভিজিৎ রায়কে হত্যার সময় এক নারী খুব  কাছাকাছি থেকে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তারা এ সময় ওই নারীর সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু পুলিশ তাদের জানায়, তারা সেই নারীর সন্ধান আর পাচ্ছেন না।

প্রত্যক্ষদর্শী নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন ডিএমপি পুলিশ সদস্য, ছবি- হিমু
কিন্তু এই তথ্য প্রকাশের পর বোঝা যাবে, পুলিশ আসলে কি সেই নারীর সন্ধান পাচ্ছে না; নাকি এড়িয়ে যেতে চাইছেন তারা, সে বিষয়ে বিতর্ক উঠতেই পারে!

বলে রাখা দরকার, একজন অনলাইন সংবাদকর্মী হিসেবে ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে আমি নিউজরুমে উপস্থিত ছিলাম। এ সময় আমাদের মিডিয়া হাউসের সংবাদকর্মী হিমু সকালে বুয়েটের একটা অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করার জন্য ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে লোকজন দেখে সেখানে যান এবং হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ওই নারীর সঙ্গে কথা বলেন। এরপর  তুলি নামে ওই নারীর সমস্ত বর্ণনা নিউজরুমে ফোনে জানিয়ে দেন।

এরপর সংবাদকর্মীর বর্ণনা মতো সংবাদও তৈরি করা হয়। হিমু ওই নারীর কয়েকটি ছবি তুলে নিউজরুমে পাঠিয়ে দেন। ওই ছবিতে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও ওয়াকিটকি হাতে ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।

তাহলে প্রশ্ন, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন যাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, তাকে কীভাবে খুঁজে পাবেন না, তা বোঝা মুশকিল! এটা কোনোমতেই কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।

পরবর্তীতে ওই নারীর নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন দিক চিন্তা করে সংবাদটি আর প্রকাশ করা হয়নি।

ছবি- সংগৃহীত
এ সময় বার বার বিলাপ করে শুধু তিনি বলতে থাকেন, ‘এত রক্ত আর কখনো আমি দেখিনি। এত রক্ত আর কখনো আমি দেখিনি!’

প্রশ্ন জাগে, যে তথ্য সংবাদকর্মীদের হাতে আছে, তার চেয়ে বেশি তথ্য পুলিশের কাছে থাকার কথা। কারণ, পুলিশ ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে; ছবিই তার প্রমাণ। তাহলে ওই নারীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এটা কাউকে কি বিশ্বাস করাতে পারবেন তারা!

সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের কাছে তুলি নামে সেই নারীর ছবি, নাম ও তিনি কোথায় থাকেন, সে তথ্য আছে। তাহলে পুলিশের কাছে থাকবেনা, এটা কেউ কি মেনে নেবেন!?

সংবাদকর্মী হিমু তখন জানিয়েছিলেন, পরের দিন (২৭ ফেব্রুয়ারি) আনুমানিক সকাল সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তুলি নামে ওই নারী অভিজিৎ হত্যার বর্ণনা দেন।

অভিজিৎ রায় হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার মূর্চ্ছা যান তুলি, ছবি- হিমু

অভিজিৎ রায় হত্যার বর্ণনা দিয়ে তুলি বলেন, ‘আমি এত রক্ত কখনো দেখিনি। চাপাতি দিয়ে প্রথমে ভাইকে (অভিজিৎ রায়) কোপায়। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেলে বৌদির (বন্যা) গলায় কোপ দেয় তারা।’

তিনি বলেন, তাদের (অভিজিৎ ও বন্যা) ওপর হামলাকারী ব্যক্তি বোরখা পরে ছিলেন। তার পিঠে একটি ব্যাগ ছিল। হামলাকারীর ঠিক পেছনেই অন্য একজন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল।

হামলার পর লোকজন জড়ো হলে হামলাকারীরা চলে যায়।

হামলা চলাকালে একটু দূরেই অবস্থান করছিলেন জানিয়ে তুলি বলেন, ‘বোরখা পরা ওই ব্যক্তি পালানোর চেষ্টা করলে আমি তার হাত চেপে জাপটে ধরি। এতে আততায়ী ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকেও মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে পেটে লাথি মেরে ফেলে দেয়। এতে আমি পড়ে গেলে তারা পালিয়ে যায়।’

বার বার মূর্চ্ছা যাওয়ার কারণে তুলি কিছুই বলতে পারছিলেন না। চেতনা ফিরলে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি শুধু উত্তর দেন।

ছবি- সংগৃহীত
তুলি বলেন, অভিজিতের ওপর হামলার সময় বন্যা হাত দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করলে চাপাতির কোপে তার হাতের আঙুল কেটে মাটিতে পড়ে যায়। অন্যদিকে, অভিজিৎ রায়ের মাথার পেছনে চাপাতি দিয়ে কোপ দিলে তার মাথার মগজ ফুটপাতে ছিটকে পড়ে।

এফবিআই সদস্যরা ওই নারীর সন্ধান জানতে চাইলে তার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কথা হচ্ছে, যে তথ্য সংবাদকর্মীরা জানতে পারলেন, সে তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরাও জেনেছিলেন। তাহলে কেন ওই নারীকে খুঁজে পায়নি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশ্নটা কিন্তু সেখানেই।

এত তথ্য থাকার পরেও অভিজিৎ রায় হত্যাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে তাহলে...!?

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৫

No comments:

Post a Comment